ফ্রান্সের বর্তমান অবস্থা ও আমার পর্যবেক্ষণ
ফ্রান্সে বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছে সেটা আমার চোখের সামনে ঘটছে আর আপনারা বাংলাদেশে বসে বসে ফেসবুকে দেখছেন। অথচ ফেসবুক খুললে আপনারা যত অরাজকতা দেখছেন তার কিছুই আমি ফ্রান্সে বসে দেখছি না। এবার আসি ব্যাঙ্গচিত্রে।
ব্যাঙ্গচিত্র মানে তো বুঝেন?
কারো ব্যঙ্গচিত্র করতে তার স্টিল ফটো লাগবে; যেটার মতো করে কার্টুন বানিয়ে তাকে ব্যাঙ্গ করা যাবে। আমাদের মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর কি স্টিল ফটো আছে যে উনার কার্টুন করবে? ঐ কার্টুনে কী আছে?
দাড়ি টুপি পরিহিত একজন মানুষের কার্টুন করা হয়েছে, এই তো?
কারণ দাড়ি, টুপি আল্লাহর রাসুলের সুন্নত এবং মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
তাহলে আপনারা বলুন, যখন রাজাকার বলে মুক্তিযুদ্ধের ছবি পোস্টার ব্যানার এমনকি চলচ্চিত্রে দাড়ি টুপি ওয়ালাদের বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয় তখন আপনাদের ঈমানী শক্তি কোথায় যায়?
তখন কেন মুখে কুলুপ এটে থাকেন যখন সব জায়গায় দাড়ি-টুপি পড়া লোকদের খারাপ বলে উপস্থাপন করা হয়; যেখানে দাড়ি টুপি রাসুলের স্পষ্ট সুন্নাহ।
তখন তো খুব মজা নিয়ে উপভোগ করেন হে ভাইয়েরা!
( গতকাল ফ্রান্স তাদের ব্যঙ্গ চিত্র প্রদর্শনী সরিয়ে নিয়েছে) এর পরেও চাই প্রতিবাদ হোক।
এবার বাকস্বাধীনতার এবং হত্যার বিষয়ে আসি:
আমরা যারা ফ্রান্সে থাকি এবং যারা ফ্রান্স সম্পর্কে জানেন, তারা নিশ্চয় জানেন ফ্রান্স বাক স্বাধীনতার জন্য বিশ্বে উজ্বল দৃষ্টান্ত।
তবে আমরা যারা ফ্রান্সে আছি তারা অবশ্যই বলবো, এখন বাকস্বাধীনতার নামে ফ্রান্স সরকার যা করছে সেটা অবশ্যই অন্যায় ও গর্হিত কাজ করছে।
কিন্তু সাথে সাথে আপনাকে চেচেনিয় মুসলিম ছেলেটার আচরণটাও দেখতে হবে। গত মার্চে সে পুরো পরিবারসহ ফ্রান্সে বসবাসের অনুমতি পেয়েছে।
সে ফ্রান্সে আশ্রয় নিয়ে ফরাসী একজন প্রফেসরকে গলা কেটে দিলো।
এটা কি ইসলামের শিক্ষা? ইসলাম কি এটা শিখিয়েছে আমাদের? সে কি অন্যায় করেনি? এটা নিয়ে বিতর্ক না করে ইউটিউবে ড. ইয়াসীর কাদীর বক্তব্য শুনে আসুন।
হত্যার পেছনের ঘটনাগুলে শুনলে বুঝবেন এটার জন্য মুসলিম কমিউনিটিগুলোর দূরদর্শীতার অভাব ছিলো। এ কারনে ফ্রান্সে বসবাসরত ৫.৬% মুসলাম জীবনে অরাজনৈতিকভাবে ইসলাম পালনও কঠিন হয়ে পড়েছে। একটা মসজিদ সরকার বন্ধ করে দিয়েছে।
এটার প্রেক্ষিতে সাধারণ ফরাসীরা ক্ষিপ্র হয়ে উঠেছে। যেখানে ফরাসীরা খুব নম্র ও শান্ত স্বভাবের, কারো ক্ষতি করেনা বরং উপকার করতে চায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। গতকাল দুজন বোরকা পরিহিতা বোন আঘাতের সম্মুখীন হয়েছে।
এগুলার জন্য কারা দায়ী? একটু সুক্ষভাবে ভাবেন।
একটা সিম্পল বিষয় ভাবুন না, কাল যদি কোন রোহিঙ্গা কোন বাঙ্গালীর গলা কেটে দেয় তাহলে আপনারা কি চুপ করে থাকবেন কিংবা সরকার কি চুপ করে থাকবে?
এবার আসেন, বাংলাদেশে বসে আপনারা জানেন না, ফ্রান্সে বড় বড় ক্রাইমগুলো থেকে শুরু করে চুরি,ডাকাতি, ছিনতাই, খুন এসব কারা চালায়? এগুলা সব চালায় অধিকাংশ মুসলমানরা যাদের ফ্রান্স সরকার দয়া করে জায়গা দিয়েছে।
অথচ তারাই এখানে এসে জনপদে বিশৃঙ্খলা করছে তাও সরকার তাদেরকে বের করে দেয়না। দেশে যখন ছিলাম সিরিয়া ফিলিস্তিন ইয়ামেন আফগানিদের ভিডিও দেখে কেদেছি।
কিন্তু জানেন এদেরকে ফ্রান্স দয়া করে আশ্রয় দেয়ার পরেও তারা এখানে এসে অরাজকতা করে। এরপরেও সরকার তাদের খাদ্য,চিকিৎসা, বাসস্থানের নিরাপত্তা দিচ্ছে।
এখন আসেন ফ্রান্সের পণ্য বয়কট এবং প্রতিবাদ নিয়ে-
ফ্রান্সের পণ্য বয়কটের পক্ষে আমি নিজেও।
কিন্তু আপনারা যারা বাংলাদেশে বসে ফ্রান্সের পণ্য বয়কটের কথা বলেন আমার খুব হাসি পায়।
বাংলাদেশে রিয়েল ফরাসী পণ্য কেনার সামর্থ্য আছে কয়জনের? এই যে গার্নিয়ার, লরিয়েল এসব আপনারা দেখেন এগুলা তো পুরান ঢাকার চকবাজার আর ধোলাই খালের পাড়ে বানায় দেশি কারিগরেরা।
বাংলাদেশে বসে আপনি এগুলারে রিয়েল ফরাসী পণ্য ভেবে ফেলে দিয়ে বয়কট করে আপনি আপনার দেশীয় ব্যবসায়ীর পেটে লাথি মারতেছেন আর কিছুনা।
ফ্রান্সের সবচেয়ে বেশি এক্সপোর্ট হয় মধ্যপ্রাচ্যে। ফ্রান্সের সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয় জেট বিমান, এয়ার বাস যেগুলোর প্রধান ক্রেতা হলো মধ্যপ্রাচ্য তথা মুসলিম দেশগুলো। আপনারদেরসহ সারা বিশ্বে বিক্রিত এসব লিপিস্টিক, সাবান, শ্যাম্পু পারফিউম গুলোর থেকে যে আয় হয় সেটা দিয়ে ফ্রান্সের বিক্রিত জেট বিমানের একটা নাট বল্টু ও কেনা যাবে না।
সুতরাং এসব পণ্য বয়কট করে আপনারা ফ্রান্সের একটা চুল ও ছিড়তে পারবেন না। কারণ ফ্রান্স আফ্রিকা কলোনি দেশ গুলোকে শোষণ করে সম্পদের পাহাড় করেছে। ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে না জানলে গুগল করে জেনে নেন।
সুতরাং যদি কিছু করতেই চান তাহলে বাংলাদেশ সরকার এবং মুসলিম দেশগুলোকে প্রেসার দেন যাতে তারা কুটনৈতিকভাবে প্রেসার করে।
এখন আপনাদের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ টনক নড়ার মতো তথ্য দেই, কুয়েত,কাতার, সৌদি আরব এই শক্তিশালি তিন মুসলিম দেশ ফ্রান্সের মালিকানাধীন এয়ার বাস ও দাসো রাফেল কোম্পানির কাছে ৭৫ মিলিয়ন ডলারে বাণিজ্যিক অর্ডার করে তা এখনো বাতিল করেনি। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু -১ স্যাটেলাইট তালিস আলেনিয়ার যেটি তৈরী করেছে ফ্রান্স, সেটি এখনো চলছে দেদারসে। সুতরাং এসব বড়বড় প্রজেক্টগুলো মুসলিম প্রধান শাসকদের বয়কট করতে বলেন।
আপনার আমার পণ্য বয়কটের ওদের তেমন কিছুই হবেনা। যেখানে আরবের বড় ব্যবসায়ীরা ফ্রান্সের দামী দামী পারফিউম ছাড়া চলতেই পারেনা।
সুতরাং আপনাদের মিছিল মিটিং সমাবেশ দায়সারভাবে যেন না হয়। এমনভাবে করেন যাতে সরকারের টনক নড়ে।
সর্বশেষ এটা বলতে চাই, মুসলমানেরা হলো বীরের জাতি।
আমরা সবসময় সারা পৃথিবী রাজত্ব করে এসেছি সেটা আপনারা ভুলে বসে আছেন। সুতরাং প্রতিবাদ হোক সেটা যেন কার্যকরী প্রতিবাদ হয়।
বাকী বিল্লাহ শিবলী
ফ্রান্স প্রবাসী